বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্পের নাম কুটির শিল্প। এ শিল্পে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির প্রতিভাস ফুটে ওঠে, যার নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। নিজেদের জীবিকা এবং নিজসত ব্যবহারের জন্য তারা এ সকল পণ্য উৎপাদন করে। বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ কুটির শিল্পের ডিজাইনে বা মোটিভে দেখা যায়। কুটির শিল্পকে অনেকে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, সৌখিন শিল্পকর্ম, গ্রামীণ শিল্পও বলেন। বর্তমানে শহর এলাকায়ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর মতে, ‘যে শিল্প কারখানা একই পরিবারের সদস্য দতারা পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত এবং পারিবারিক কারিগর খন্ডকালীন বা পূর্ণ সময়ের জন্য উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকেন এবং যে শিল্পে শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহূত হলে ১০ জনের বেশি এবং এবং শক্তি চালিত যন্ত্র ব্যবহূত না হলে ২০ জনের বেশি কারিগর উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকেনা তাই কুটির শিল্প’। জাতীয় রাজসত বোর্ড শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি ব্যতিরেকে অনুর্ধ্ব ৫০ জন শ্রমিক নিয়োজিত কারখানাকে কুটির শিল্প হিসেবে গণ্য করেন। কৃষিশুমারি (১৯৮৩-৮৪) কুটির শিল্পকে গার্হস্থ্য স্তরের উৎপাদন শিল্প বলে আখ্যায়িত করেছে। শিল্পনীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যয়সহ ৫ লক্ষ টাকার নীচে এবং পারিবারিক সদস্য সমনতয়ে সর্বোচ্চ জনবল ১০-এর অধিক নয় এরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কুটির শিল্প।
কুটির শিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ বিবরণী থেকে জানা যায়, তৎকালে বাংলায় পৃথিবীখ্যাত মসলিন উৎপাদিত হতো। প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় সুতিবস্ত্র উৎপাদন বিশুদ্ধ কারুশিল্পরীতি বা গৃহে উৎপাদনের ব্যবস্থা দ্বারা সুসংগঠিত ছিল। মুগল যুগে কুটির শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা প্রথমদিকে বাংলার কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য তাঁত ও অন্যান্য হস্তশিল্পকে অর্থ জোগান দিত। পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ তাঁতবস্ত্র, বয়নশিল্প ও অন্যান্য কুটির শিল্পে নির্যাতন চালায়। যেখানে ১৮১৫ সালে এদেশ থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার কাপড় রপ্তানি হয়েছে সেখানে ১৮৩২ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০ লক্ষ টাকায়, পরের বছর তা শূণ্যের কোটায়। উল্টো ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বিদেশি কাপড় আমদানি করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে এ দেশের কুটির শিল্পজাত পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ শিল্পের ব্যবসা প্রধানত হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল। দেশ বিভাগের ফলে তাদের অধিকাংশ দেশ ত্যাগ করে। ফলে কুটির শিল্পজাত ব্যবসায় বড় শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিক কুটির শিল্পে বৃহৎ বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। এর মধ্যে প্রায় ৬৫% ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। প্রায় ১ হাজার ৬ শত পেশাজীবী কারিগর নিয়োজিত ছিল। তাঁত শিল্পে নিয়োজিত ছিল প্রায় ৪ লক্ষ লোক। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ শিল্প বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার এদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৫৭ সালে সরকারি আইনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কুটির শিল্পসহ সমগ্র শিল্পখাত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার কুটির শিল্পকে পুনর্গঠন এবং কর্মসংস্থানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে পুনর্গঠন করে নতুন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী নৈপূণ্যভিত্তিক প্রযুক্তির পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, সমীক্ষা প্রণয়ন, বিপণন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়োজিত কারুশিল্পীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ১৯৮১ সালে বিসিক-এর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৬০ ধরনের দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনে ৩ কোটি ২২ লক্ষ কুটির শিল্পের কারখানা বিদ্যমান রয়েছে।
আর্টিকেল/বাংলাপিডিয়া

0 Comments